বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৪০টি আসনে জিতে চমক সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশের ধারণা ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি’ আওয়ামী লীগ একটি সুসংগঠিত দল হিসেবে অনায়াসে ক্ষমতায় আসবে, যা বড় ধরণের ধাক্কা খায় এই নির্বাচনের পর।
আওয়ামী লীগের সহানুভূতিশীল সাংবাদিকদের পরিচালিত পূর্বাভাস নামে একটি ম্যাগাজিনে তখন ছাপা হয়েছিল তৎকালীন বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্য। ম্যাগাজিনটি সম্পাদনা করতেন মোজাম্মেল বাবু। হুমায়ূন আহমেদ, কবীর চৌধুরী, ফরহাদ মযহার, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হায়দার আকবর খান রনো, রামেন্দু মজুমদার প্রমুখ তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। তাদের বক্তব্য হুবুহু প্রকাশ করা হলো। কিছুক্ষেত্রে বোঝার সুবিধার্থে বানান সংশোধন করা হয়েছে।
অধ্যাপক কবির চৌধুরী
বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে এই প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণ, নিরাপদভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জনগণ কোনরকম চাপ ছাড়াই তাদের ভোট দিতে পেরেছে।
মানুষের মধ্যে ভয় ছিলো; দ্বিধা ছিলো যে গণ্ডগোল হবে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটেনি। এটাই আমার কাছে অত্যন্ত ভালো লেগেছে। ফলাফল নিয়ে আমি এ মুহূর্তে কোন মন্তব্য করতে চাই না। ২৭ তারিখ রাতে টিভিতে ফলাফল শুনেছি আজও শুনেছি। তবে মানুষের একটি বদ্ধমূল ধারণার অনেকটা বদল হয়েছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
এই ফলাফলে বিস্মিত হয়েছি। পরিসংখ্যানটা এমন দাঁড়াবে কখনো মনে করি নাই। ভেবেছিলাম আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বিএনপি এতো ভালো করবে – ভাবতে পারিনি; অবশ্য এমন ধারণা বোধ করি সকলেরই ছিলো। আওয়ামী লীগ একটি পুরনো সংগঠন, বড় দল হিশেবে তাদের আরো ভালো করা উচিত ছিলো।
অবশ্য বিএনপি’র এই জয়ের পেছনে একটি স্রোত কাজ করেছে। তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি তেমন শক্ত নয়, তাছাড়া নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও তেমন নেই। সর্বোপরি তারা সাধারণ জনগণের মাঝ থেকে উঠে আসা সংগঠন নয়। তবুও তারা ভালো করেছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ জনগণের ভেতর থেকে উঠে আসা সংগঠন হয়েও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো – এর কারণ হতে পারে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থা নেই। তাছাড়া আন্দোলনে আওয়ামী লীগের দোদুল্যমনতা ছিলো বলেও অনেকের ধারণা।
তাছাড়া আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার ২৫ তারিখের বেতার-টিভি ভাষণের প্রতিক্রিয়াও তার বিপক্ষে গেছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাথে ভারত সম্পর্ক নিয়ে একটি ভয় ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেছে – এইসব কারণেই বিএনপি ভালো করেছে। তারা সরকার গঠন করুক – তবে জামাতের সঙ্গে যদি বিএনপি কোয়ালিশন করে তাহলে হতাশ হবো।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ (বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক)
অনেকদিন দেশে তেমন কোন নির্বাচন হয়নি। ফলে জনগণের মধ্যে একটা দ্বিধা ছিলো নির্বাচন নিয়ে। আমাদের মধ্যে যে একটা শৃঙ্খলা শক্তি রয়েছে, আমরা তা কাজে লাগাতে পারি তারই প্রমাণ হলো।
এটা সত্যি একটা ব্যতিক্রমধর্মী ফলাফল। তবে এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটি আশীর্বাদও বটে। কেননা ‘৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যেখান থেকে শুরু করেছিলেন; আজ আওয়ামী লীগকে সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। দেশে একটা অর্থনৈতিক সংকট বিরাজমান এটা মেটাতে হতো। ফলে শেখ মুজিব যে অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সে সংকটে পড়তো।
তবে তাদের এই আশাহত ফলাফলের জন্যে যে কারণগুলো আছে, তাহলো-
১. আওয়ামী কর্মকান্ড এবং শেখ মুজিবের শাসনামলের আতঙ্ক।
২. জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা।
৩. আওয়ামী লীগের জোড়াতালি দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা।
অবশ্য সাংগঠনিকভাবে দু’টো দলই দুর্বল। তবুও বিএনপি সক্রিয় কাজের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একটি নতুন নতুন হিশেবে তাদের তেজ ও শক্তি আছে। এই শক্তিকে তরুণরা গ্রহণ করেছে। আজকে যারা তরুণ তারা শেখ মুজিবকে দেখেনি, তার কথাও তেমন শোনেনি। তারা জিয়ার আমল দেখেছে এবং তার দল যা গ্রহণ করেছে বিএনপি’র একমুখিতাও এক্ষেত্রে কাজ করেছে। আর এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকটা সংকটের সৃষ্টি করেছে। এর পাশাপাশি ধর্ম আমাদের দেশে একটা বিরাট ব্যাপার। বিএনপি এটাকে কাজে লাগাচ্ছে। এ প্রশ্নে জামাতের সঙ্গে তাদের সাযুজ্য আছে এবং তাদের সঙ্গেই কোয়ালিশন হতে পারে।
মানুষ খুব সন্ত্রস্ত ছিলো। গণতন্ত্র হারানো যে দুঃখ মানুষ সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে।
তবে আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্লেষণের সময় এসেছে।
হায়দার আকবর খান রনো (পাঁচদল নেতা)
জনগণ ভালোভাবে ভোট দিয়েছে; সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে এটা খুব ভালো লাজ্ঞছে। নির্বাচনের ফলাফলে মোটেও আশ্চর্য হইনি। কারণ আমি আগেই জানতাম এমন কিছু হবে। আমি একমাস আগে এক বিবৃতিতে উল্লেখও করেছিলাম বিএনপি মেজোরিটি পাবে। আন্দোলনে বিএনপির আপোষহীন মনোভাবের প্রকাশ তাদের এই ফলাফলে সহায়তা করেছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ৮৬’র নির্বাচন, আন্দোলনে তাদের ভূমিকা, সর্বোপরি আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী হিশেবে প্রচারণা চালো হয়েছে এটা এবারের নির্বাচনে বেশ কাজ করেছে। তাছাড়া শহর ভিত্তিক বিএনপি’র একটা ইমেজ গড়ে উঠেছে। এবারের আন্দোলনটাও শহরভিত্তিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন। এটাও বিএনপি’র জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। পাশাপাশি জাতীয় পার্টির এতোগুলো সিটপ্রাপ্তিতেও বিস্মিত হওয়ার তেমন কিছু নেই – এখানেও স্থানীয় প্রভাব এবং টাকা কাজ করেছে।
তবে আমার ধারণা হলো এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হলো। এই নির্বাচন এবং এই ফলাফলের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশন, খালেদা জিয়া ও জনগণকে অভিনন্দন জানাই।
রামেন্দু মজুমদার (আন্তর্জাতিক নাট্য সংস্থার সভাপতি)
আমরা মনে করি নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে। এখন জনগণের এই রায়কে সবার শ্রদ্ধা জানানো উচিত। তবে ফলাফল এমন হবে এ ধারণা ছিলো না। বিএনপি’র এতো ভালো করার পেছনে কারণগুলো হলো – ক. নতুন জেনারেশন বিএনপিকে গ্রহণ করেছে। খ. উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মহিলা ভোট দিয়েছে এবং তারা বিএনপি’র পক্ষে রায় দিয়েছে। বিএনপি’র এই জনপ্রিয়তার কারণ হলো আওয়ামী লীগ ভারতপন্থী – এ মিস প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে কোন কোন মহল। ফলে বিএনপিকেই নতুন জেনারেশন গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের এ পরাজয়ের আরো অনেক কারণ আছে; তবে নির্বাচনে কারচুপি হয়নি। ভোটার লিস্টে গন্ডগোল আছে। অনেক সাধারণ জনগণের নাম লিস্টে ছিলো না। তারা ভোট দিতে পারে নাই। তবে সব রাজনৈতিক দলের আগেই এটা পরীক্ষা করা উচিত ছিলো। তবে ফলাফল যাই হোক; জাতীয় পার্টির এতোগুলো সিট জেতায় আশ্চর্য হয়েছি।
হুমায়ুন আহমেদ (উপন্যাসিক)
আমি সংসদ নির্বাচনে এই ফলাফলে বিস্মিত হয়েছি। কখনো ভাবিনি এমনটা হবে। বিএনপি’র এত ভালো করা এবং সুসংগঠিত দল আওয়ামী লীগের এতো বড় ব্যর্থতার কারণ কি হতে পারে তা রাজনীতিবিদরা ভাববেন। তবে খালেদা জিয়ার আপোষহীন যে ভূমিকা প্রকাশ তা অনেকটা কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের এ ফলাফলের জন্য অনেকাংশে দায়ী তাদের ওভার কনফিডেন্স। যাই হোক – নির্বাচন খুব সুন্দর হয়েছে। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে গিয়েছে। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। তারা ধর্মকে কিছুটা ব্যবহার করেছে তবে সরকার গঠন করতে গিয়ে যদি তারা জামাতের সঙ্গে কোয়ালিশন করে এটা আমার ভালো লাগবে না।
ফরহাদ মযহার
এটা সারপ্রাইজিং। প্রত্যাশা করিনি। বিএনপি’র এ সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে আন্দোলনে তাদের ভূমিকা এবং ইয়াংদের চয়েজ।
ওভার কনফিডেন্স আওয়ামী লীগের এ হতাশ ফলাফলের কারণ। তাছাড়া এদেশের আম্নুষের মধ্যে ভারত আতঙ্ক রয়েছে, জাতীয়তাবাদ নিয়েও একটা অস্পষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। এগুলো আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কাজ করেছে।
বিএনপি, জামাত, ফ্রিডম পার্টি সব সময়ই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধ শক্তি হিশেবে কাজ করেছে। ২৫ মার্চ টেলিভিশনে শেখ হাসিনার বক্তব্যটি ছিল আনইম্প্রেসিভ। এটাও ভোটারদের উপর প্রভাব ফেলেছে। আওয়ামী লীগ তাদের আমলের কালাকানুনগুলো নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কগুলো স্পষ্ট করেনি। সবকিছু মিলিয়ে বিএনপি’র জন্য একটি ভালো অবস্থান তৈরি হয়েছে।
এখন বিএনপি সরকার গঠন করবে। তারা একটি দক্ষিণপন্থী বলয় গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে। এখানে ধর্মকে তারা ব্যবহার করবে। বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা সব সময়ই তাই করে থাকে।
আসলে বিএনপি আওয়ামী লীগ দু’টোই কমিউনাল। একটি ধর্মকে ব্যবহার করেছে, আরেকটি সমাজতন্ত্রের নাম ব্যবহার করেছে। মূলতঃ এরা কতটা জনগণের সেবা করবে সেটাই প্রশ্ন। এক্ষেত্রে একটি দেশপ্রেমিক, প্রকৃত দেশপ্রেমিক তৃতীয় শক্তির উত্থান প্রয়োজন যে শক্তিটা জনগণের পক্ষে কাজ করবে।