বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে দিয়ে দল দুইটিকে সংস্কার করে ‘নতুন ধারার’ রাজনীতি চালু করার একটা চেষ্টা করা হয় ২০০৭ সালে, যা মাইনাস টু ফর্মুলা নামে পরিচিতি পায় রাজনৈতিক অঙ্গনে।
দুই শীর্ষ নেতাকে ‘মাইনাস’ করা হবে এমন আভাস প্রথম পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতদের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ‘AMBASSADOR AND BRITISH HIGH COMMISSION MET WITH SHEIKH HASINA REGARDING MILITARY COUP‘ শীর্ষক তারবার্তা থেকে জানা যায়, ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার সাথে এক আলাপচারিতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস এবং যুক্তরাজ্যের আনোয়ার চৌধুরী তাকে জানান যে তার দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির কিছু নেতা তাকে এবং তার ‘শত্রু’ খালেদা জিয়াকে দেশত্যাগে বাধ্য করতে চায় এমন প্রস্তাব দূতাবাসগুলোর কাছে দেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা বিষয়টির উত্তরে ঠাট্টাচ্ছলে জানান যে এমন হলে তিনি তার শেষ জীবন যুক্তরাষ্ট্রে তার নাতনীর সাথে কাটাতে পারবেন। তিনি আরো বলেন – যদি সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি ‘ঠিক’ করে দিতে পারে, তার কোন আপত্তি নেই।
এর ৭ দিন পর দেশে সামরিক বাহিনীর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে নতুন সরকার গঠিত হয় এবং ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়ন শুরু হয়।
নতুন সরকার গঠন হওয়ার দুই মাসের মাথায় মার্চের প্রথম সপ্তাহে গ্রেপ্তার করা হয় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে। এর এক সপ্তাহের মাথায় শেখ হাসিনা ‘ছেলে, ছেলের স্ত্রী ও নাতনীর সাথে সময় কাটাতে’ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ। যাওয়ার আগে তিনি বলেন তাকে কেউ ‘অনির্ধারিত সময়ের জন্য’ দেশত্যাগে বাধ্য করেনি এবং “যৌথ বাহিনী অনেক ভালো কাজ করছে” বলে জানান। তিনি ঠিক কতদিন থাকবেন এই প্রশ্নের উত্তর তিনি না দিলেও তার প্রেস সচিব বলেন, ‘প্রায় একমাসের মত’।
এরপর শুরু হয় খালেদা জিয়াকে দেশছাড়া করার উদ্যোগ। তাকে চাপ দেয়া হয় সৌদি আরব চলে যেতে। ১৫ এপ্রিল রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা বৈঠকের পরও তিনি রাজি না হলে গ্রেপ্তার করা হয় তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমানকে। পরদিন সকালে দি ডেইলি স্টার প্রকাশ করে ‘Arafat ‘picked up’ in late night raid’ শিরোনামে প্রতিবেদন। পাশাপাশি পত্রিকাগুলো শুরু করে আরাফাত রহমানের বিভিন্ন কথিত দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর সূত্র থেকে জানানো হয় আরাফাত রহমানকে নিয়ে খালেদা জিয়া দেশত্যাগে রাজি হয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পরেই আরাফাত রহমানকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৭ এপ্রিল দি ডেইলি স্টার সামনের পাতায় প্রকাশ করে দুইটি প্রতিবেদন – Khaleda agrees to fly out with Arafat এবং Arafat released after quizzing over graft।
কিন্তু আরাফাত রহমানকে ছেড়ে দেয়ার পর এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া জানিয়ে দেন তিনি যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে হলেও দেশে থাকবেন।
এই প্রসঙ্গে তৎকালীন ডিজিএফআইর শীর্ষ কর্মকর্তা ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী লেখক ও গবেষককে মহিউদ্দিন আহমদকে সাক্ষাৎকারে বলেন, “পরে উনি (খালেদা জিয়া) বলছেন আমি যাব না। এরপর মেজর আখতার বলেছে, ম্যাডাম, আপনি মাটি কামড়াইয়া পইড়া থাকেন। যবেন না। যাই হোক, যাওয়া অ্যারেঞ্জ করা যায় নাই।
তো উনি একলা মাঠে গোল দিয়া দিবে? তখন শেখ হাসিনাও চইলা আসার পাঁয়তারা শুরু করল। এটা ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় চিঠিপত্র লেখানো হইল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।”
খালেদা জিয়ার এই সিদ্ধান্তে মাইনাস টু ফর্মুলা মুখ থুবড়ে পড়ে।
খালেদা জিয়া দেশ ছাড়ছেন না এমন সংবাদে, একমাসেরও বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকা শেখ হাসিনা দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে ফেরার চেষ্টা করতে থাকেন এবং ২১ এপ্রিল লন্ডনের ফ্লাইটে ওঠেন। এর আগে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে সরকার একটা প্রেসনোট জারি করে রেখেছিল ১৮ এপ্রিল।
২২ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ সবাইকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, “বেগম খালেদা জিয়া সৌদি আরবে যাবেন না। তিনি যেকোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে তৈরি, তবু দেশ ছাড়বেন না।” ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোর লিড নিউজ ছিল ‘খালেদা জিয়া আজকালের মধ্যে যাচ্ছেন না’।
এরপর ৬ মে শেখ হাসিনাও দেশে ফিরে আসেন। এর আগে তার দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। কিছুদিন পর থেকে শুরু হয় দুই নেত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেয়া।
২০০৭ সালের ১১ জুন প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখার শিরোনাম ছিল, ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’। এই লেখার জন্য প্রথম আলো সম্পাদক পরে শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন বলে জানা যায়।