১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয় একতরফা নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে যেখানে অবধারিতভাবেই জিতে আসে বিএনপি।বিএনপির দাবি ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এই নির্বাচন প্রয়োজন ছিল।

উল্লেখ্য, মাগুরার উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপিকে কেন্দ্র করে সংসদের সব বিরোধীদল জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ১৯৯৪ সাল থেকেই। জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেয় আওয়ামী লীগ এবং ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়।

এমন অবস্থায় কমনওয়েলথের মহাসচিব স্যার নিনিয়ান স্টেফান ঢাকায় আসেন এবং বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সাথে আলোচন করেন। তিনি প্রায় ছয় সপ্তাহ ঢাকায় ছিলেন। তিনি দশ সদস্যের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দেন যার প্রধান হবেন খালেদা জিয়া এবং পাঁচজন সদস্য থাকবেন বিরোধীদলের মনোনীত। তবে তারা কেউই কোন দায়িত্ব পালন করবেন না, বরং দায়িত্ব পালন করবেন বিভাগীয় প্রধান তথা সচিবরা।

তৎকালীন বিএনপি সরকার এই ফর্মুলা গ্রহণ করলেও আওয়ামী লীগ এটি প্রত্যাখান করে। স্যার নিনিয়ান স্টেফানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও তুলেছিল আওয়ামী লীগ।

ক্যনবেরা টাইমসে ১৯৯৪ সালের ২৪ নভেম্বরে প্রকাশিত তার এক সাক্ষাৎকারে স্যার নিনিয়ান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের পেছন কোন আদর্শগত সংঘাত নেই কিন্তু তাদের মধ্যকার “গভীর সন্দেহ ও বিশ্বাসভঙ্গের শঙ্কা” এই সমস্যার মূল কারণ।

“বিরোধীদলীয় নেত্রী (শেখ হাসিনা) ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ঘৃণা করেন এবং তার একমাত্র দাবি হচ্ছে তাকে (খালেদা জিয়াকে) পদত্যাগ করতেই হবে,” স্যার নিনিয়ান দাবি করেন, যদিও খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদ ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রয়েছে।

ক্যনবেরা টাইমসে ১৯৯৪ সালের ২৪ নভেম্বরে প্রকাশিত স্যার নিনিয়ানের সাক্ষাৎকার।

সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি না মেনে নেয়ায় সেই বছর ডিসেম্বরে সংসদ থেকে ১৪৭ জন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদত্যাগ করে। পদত্যাগীদের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। যদিও তখন তাদের পদত্যাগপত্র স্পিকার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন, ১৪৭ জন সাংসদ সংসদে ফিরে না আসায় ৯০ কার্যদিবস পর তাদের সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা হয় নিয়ম অনুসারে।

যেহেতু সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন রয়েছে, বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের সংসদীয় আসন শূন্য হয়ে যাওয়ায় সংবিধানে সংশোধনী আনতে হলে, হয় সেই ১৪৭ আসনে পুনঃর্নিবাচন অথবা সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিরোধী দলগুলো পুনঃনির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণা দেয়।

এদিকে রাজপথে বিরোধীদলের আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে এবং দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতেও হামলা চালানো হয়। এমন অবস্থায় নভেম্বর মাসে খালেদা জিয়া পুনঃনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধীদলের সদস্যদের সংসদে ফিরে এসে আলোচনার দাবি জানান। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা বিরোধীদলগুলো সেই দাবিও প্রত্যাখান করে।

তাই, ১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয় নির্বাচনের তারিখ।

কিন্তু এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যপক সহিংসতার আশঙ্কা ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। অনেক ঝুঁকি নিয়েই নির্বাচন করতে হয়। দশ শতাংশ ভোটারও প্রকৃতপক্ষে ভোট দেননি।

এই প্রসঙ্গে ২০১২ সালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, “সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া সংবিধান সংশোধন করে কেয়ারটেকার বিল পাশ করা সম্ভব ছিল না। তখন (অর্থাৎ ৫ম সংসদে) বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। পঞ্চম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে যদি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে দাঁড়াবেটা কি? তাহলে তো সরকারই নাই। সরকার না থাকলে কে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে? এ রকম একটা সংকটের সময়ে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদের নির্বাচন দিতেই হলো।”

তিনি দাবি করেন এই নির্বাচনের পর গঠিত বিএনপি সরকার অন্য কোন কাজ করেনি, শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটি পাশ করেছিল।

এদিকে নির্বাচনের পর থেকেই আন্দোলন আরও সহিংস হয়ে ওঠে। সচিবালয়ে আওয়ামী পন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদ্রোহ করে।

নির্বাচনের এক মাসের মধ্যে নতুন সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয় বিএনপি সরকার।

১৯৯৬ সালের জুন মাসে নতুন নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ১৪৬ আসন জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি জিতে আসে ১১৬টি আসনে। জাতীয় পার্টি পায় ৩২টি আসন। জামায়াতে ইসলামীর ভরাডুবি হয় নির্বাচনে, মাত্র ৩টি আসনে জিততে পারে দলটি।